ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে যুদ্ধজয়ের একক কৃতিত্বের দাবী। |
ইতিহাস বলে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করার পর তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারে কর্মরত বাংলাদেশীদের মাধ্যমে। আতাউল গনি ওসমানীর সর্বাধিনায়কত্বে দীর্ঘ সাড়ে আট মাস এই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেে বাংলাদেশের 'মুক্তিবাহিনী'।
এই দীর্ঘ সময়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে গাবুরে মার খাওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন হয়রান পেরেশান, তখন ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে যোগ দেয় এবং 'ভারতীয় সেনাবাহিনী' ও 'মুক্তিবাহিনী'র সমন্বয়ে তৈরী হয় মিত্র বাহিনী। ১৩ দিনের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এই মিত্র বাহিনীর কাছে। এই যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ চুড়ান্তভাবে স্বাধীন হয়।
যাদুঘরে সংরক্ষিত পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলটি পড়লে দেখতে পাবেন সেখানে জগজিত সিং অরোরা স্বাক্ষর করেছেন ভারত ও বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে। দলিলে স্বাক্ষরের নীচে তার পরিচয় লেখা আছে- JAGJIT SINGH AURORA, Lieutenant-General, General Officer Commanding in India and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre ।
কিন্তু আশ্চর্যভাবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রনীত হবার পর প্রস্তাবনা অংশে লেখা হয়, 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি'। যে জাতি যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করলো, তার প্রথম সংবিধানেই কেন যুদ্ধ জয়ের দলিলে নিজেদের বিজয়ের প্রমান উপেক্ষা করে সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা লেখা হলো? শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হিসেবে যে তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো ছিল (১) সাম্য, (২) মানবিক মর্যাদা ও (৩) সামাজিক ন্যায় বিচার। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন এবং আত্মত্যাগ করেছেন এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখেই।
কিন্তু ৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আদর্শকে আমুল পাল্টে দিয়ে লেখা হলো, 'যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।' খেয়াল করে দেখুন, মুক্তি'যুদ্ধ'কে পাল্টে দিয়ে লেখা হলো মুক্তি 'সংগ্রাম', এবং 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায় বিচার' উধাও করে দিয়ে আমদানী করা হলো- 'সমাজতন্ত্র' আর 'ধর্মনিরপেক্ষতা'! [মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত 'ধর্মনিরপেক্ষতা' কিভাবে সংবিধানে ঢুকলো, সেটা নিয়ে পরে কখনো লিখবো]
যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তিতে আপনার নিজের অংশকে যদি আপনি নিজেই অস্বীকার করেন, তাহলে সেটি তো অবধারিতভাবেই আপনার অপর অংশীদারের একক সম্পত্তিতে পরিনত হবার কথা। যে 'যুদ্ধ' (war) যৌথভাবে জিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, নিজেদের প্রথম সংবিধানেই যদি সেটার অস্তিত্ব অস্বীকার করে 'সংগ্রাম' (struggle) লিখা হয়, তাহলে ঐ যুদ্ধ জয়ের অংশীদারিত্বও যে আপনা আপনি চলে যায়, সেটি কি ৭২ এর সংবিধান প্রনেতারা বোঝেন নাই? উনারা ঠিকই সেটা বুঝেছিলেন এবং জানতেন।
তাহলে তারপরও কেন 'যুদ্ধ'কে 'সংগ্রাম' লেখা হলো?
এটা লেখা হয়েছিল মূলত: দুইটি কারণে। প্রথমত: যুদ্ধে অংশ না নেয়া শেখ মুজিব হতে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল কৃতিত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকে তাদের চেয়ে পেছনে রাখতে। দ্বিতীয়ত: চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে যুদ্ধবিজয়ীর একক কৃতিত্ব দিতে।
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা এবং বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন, তখন পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এই ভুল তথ্য শুধরে দিয়ে লেখা হয়- 'ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি'।
বাংলাদেশ যখন সাংবিধানিকভাবে তাদের নিজেদের জয় করা যুদ্ধকে অস্বীকার করে; যুদ্ধ বিজয়ে নিজের অংশীদারিত্ব ত্যাগ করে, তখন ভারত কেন এই সুযোগ লুফে নিয়ে যুদ্ধ বিজয়ের একক কৃতিত্ব দাবী করবে না?
কাজেই ১৬ ডিসেম্বরকে ভারত কর্তৃক এককভাবে তাদের বিজয় দিবস দাবী করার কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের আগে নিজেদের নেতাদের জিজ্ঞেস করুন- কেন তারা জয় করা 'যুদ্ধ'কে 'সংগ্রাম' বানিয়ে যুদ্ধ বিজয়ে নিজেদের অংশীদারিত্ব ভারতের হাতে তুলে দিলো।