যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা পাচারের নেপথ্যে ছিল ‘রাষ্ট্রীয় মদদ’; বলছেন ওই ঘটনার তদন্তে ফিলিপাইনে থাকা এক এফবিআই কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত না জানালেও এফবিআই রিজার্ভ চুরির হোতাদের নাম-পরিচয় খুব শীঘ্রই প্রকাশ করবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় পাচার করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ এক মাস গোপন রাখার পর ফিলিপাইনের মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়। প্রথমে এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা পাকিস্তানী এবং চীনা হ্যাকারদের দায়ী করলেও গত ২২ মার্চ ২০১৭ তারিখে ভারতীয় সাংবাদিক অরুণা বিশ্বনাথা এবং চীনা বংশোদ্ভুত মার্কিন সাংবাদিক নিকোল হংগ ওয়ালস্টিট জার্নালে একটি প্রতিবেদন লিখে এফবিআই এর অসমর্থিত সূত্রের উল্লেখ করে দাবী করে যে এই ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র সাথে উত্তর কোরিয়া জড়িত! একই দিন রয়টারও ওয়ালস্টিট জার্নালের সেই প্রতিবেদনের রেফারেন্স দিয়ে একই দাবী করে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের সরকারী, সরকার সমর্থক এবং সরকারী চাপে থাকা সকল মিডিয়া সমস্বরে এই সংবাদ ব্যানার হেড করে।
দেশি-বিদেশী সকল মিডিয়াতেই বিশ্বনাথা-হংগ এর বরাতে দাবী করা হয় "বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) উত্তর কোরিয়াকে দায়ী করার পর এই দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করছে যুক্তরাষ্ট্রেরই ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। মার্কিন আইনজীবিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির পেছনে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।"
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই চাঞ্চল্যকর রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ ঘটনায় ঊর্ধ্বতন ২ কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত।
শুধু তাই নয়, গত ২৬ জুলাই ২০১৭ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর তদন্ত প্রতিবেদনের রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়, "রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সুইফট এবং ভারতীয় একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান জড়িত। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা।" উল্লেখ্য যে, এই রাকেশ আস্তানাকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তার জন্য উচ্চ বেতনে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। এই ঘটনাকে 'ইনসাইড জব' উল্লেখ করার কারণে সরকারের সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহাকে কয়েকদিনের জন্য গুম করেছিল কোন একটি গোয়েন্দা সংস্থ্যা।
গত ২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখ বিবিসি বাংলা "রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে ফিলিপিনের ইনকোয়ারার পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রথমে বিস্তারিত ফাঁস করে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন, তার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, "বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে ফিলিপিনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে"।
বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদন প্রকাশের দুই ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ১৪ তলায় বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগে, যেখান থেকে ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে রিজার্ভ লুটের ঘটনা ঘটেছিল এবং যেখানে রিজার্ভ লুটের আলামত ছিল সেখানে রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে।
এই রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান সমরেন্দ্র নাথ বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ জায়গায় আগুন লাগার কথা নয়৷ ব্যাংকের ভেতরে এটাই প্রথম আগুন, যা নিভাতে ফায়ার সার্ভিসকে যেতে হয়েছে"৷
এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, "অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তা কিংবা কেউই ফায়ার সার্ভিস অফিসে টেলিফোন করেননি। স্থানীয়রাই আমাদের খবর দেন। তারপর ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের প্রায় ৭০ জন কর্মী যান ঘটনাস্থলে।"
প্রশ্ন অনেকগুলো:
১/ যেখানে ফিলিপাইনে এই বিষয়ক প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে এবং শুনানীও হয়েছে প্রকাশ্যে, সেখানে কী কারণে ড. ফরাসউদ্দিনের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি?
২/ সিআইডির করা প্রতিবেদনও কেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি?
৩/ যে রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যাংক ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্ট বলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে সিআইডি, সেই রাকেশ আস্তানাকেই কেন আবার এই ব্যাংক ডাকাতির বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হলো?
৪/ কী কারণে জোহাকে গুম করে তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো?
৫/ বিবিসিতে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগেই আগুন লাগলো এবং সেই আগুন নেভানোর জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন ফায়ার সার্ভিসে খবর দিল না?
এই প্রশগুলোর উত্তর না পাওয়া থেকে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এই ঘটনার সাথে জড়িত, তাদের নাম প্রকাশ পেলে সেই সূত্র ধরে সরকারের এমন কোন শীর্ষ ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়ে যাবে যেটা নিয়ে খোদ সরকার ভীষণ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরবে। এই ব্যাংক ডাকাতির নাটাই যদি ঐ কর্মকর্তাদের হাতে থাকতো, তাহলে সরকার তার গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জোহাকে গুম করানোর ঝুঁকি নিত না, সরকারী তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়েও রাখতো না এমনকি অভিযুক্ত রাকেশ আস্তানাকেই আবার তদন্ত করার দায়িত্ব দিত না।
এফবিআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে জেলের ভাত খাওয়ানো যায় কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডাকাতির তথ্য প্রকাশ করলে শুধু এফবিআইকে গালি দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করা যায়? বড়জোর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আগুন ধরিয়ে সমস্ত প্রমাণাদি বিনাশ করা যায়! এতোটুকুই কি যথেষ্ট নয়?