Saturday 16 December 2017

যে কারণে ভারত ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের একক কৃতিত্ব দাবী করে

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে যুদ্ধজয়ের একক কৃতিত্বের দাবী
 ১৬ই ডিসেম্বরকে কেন ভারত এক তরফাভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করছে এবং কেন আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তার প্রতিবাদ করতে পারছি না, সেটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন।

ইতিহাস বলে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করার পর তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারে কর্মরত বাংলাদেশীদের মাধ্যমে। আতাউল গনি ওসমানীর সর্বাধিনায়কত্বে দীর্ঘ সাড়ে আট মাস এই যুদ্ধ চালিয়ে গেছেে বাংলাদেশের 'মুক্তিবাহিনী'।

এই দীর্ঘ সময়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে গাবুরে মার খাওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন হয়রান পেরেশান, তখন ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে যোগ দেয় এবং 'ভারতীয় সেনাবাহিনী' ও 'মুক্তিবাহিনী'র সমন্বয়ে তৈরী হয় মিত্র বাহিনী। ১৩ দিনের মধ্যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী  আত্মসমর্পণ করে এই মিত্র বাহিনীর কাছে। এই যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ চুড়ান্তভাবে স্বাধীন হয়।

যাদুঘরে সংরক্ষিত পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলটি পড়লে দেখতে পাবেন সেখানে জগজিত সিং অরোরা স্বাক্ষর করেছেন ভারত ও বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে। দলিলে স্বাক্ষরের নীচে তার পরিচয় লেখা আছে- JAGJIT SINGH AURORA, Lieutenant-General, General Officer Commanding in India and Bangladesh Forces in the Eastern Theatre ।

কিন্তু আশ্চর্যভাবে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রনীত হবার পর প্রস্তাবনা অংশে লেখা হয়, 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি'। যে জাতি যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করলো, তার প্রথম সংবিধানেই কেন যুদ্ধ জয়ের দলিলে নিজেদের বিজয়ের প্রমান উপেক্ষা করে সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা লেখা হলো? শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলেন, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ হিসেবে যে তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছিল সেগুলো ছিল (১) সাম্য, (২) মানবিক মর্যাদা ও (৩) সামাজিক ন্যায় বিচার। মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন এবং আত্মত্যাগ করেছেন এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখেই।

কিন্তু ৭২ সালের সংবিধানে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আদর্শকে আমুল পাল্টে দিয়ে লেখা হলো, 'যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।' খেয়াল করে দেখুন, মুক্তি'যুদ্ধ'কে পাল্টে দিয়ে লেখা হলো মুক্তি 'সংগ্রাম', এবং 'মানবিক মর্যাদা' ও 'সামাজিক ন্যায় বিচার' উধাও করে দিয়ে আমদানী করা হলো- 'সমাজতন্ত্র' আর 'ধর্মনিরপেক্ষতা'! [মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত 'ধর্মনিরপেক্ষতা' কিভাবে  সংবিধানে ঢুকলো, সেটা নিয়ে পরে কখনো লিখবো]

যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তিতে আপনার নিজের অংশকে যদি আপনি নিজেই অস্বীকার করেন, তাহলে সেটি তো অবধারিতভাবেই আপনার অপর অংশীদারের একক সম্পত্তিতে পরিনত হবার কথা। যে 'যুদ্ধ' (war) যৌথভাবে জিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, নিজেদের প্রথম সংবিধানেই যদি সেটার অস্তিত্ব অস্বীকার করে 'সংগ্রাম' (struggle) লিখা হয়, তাহলে ঐ যুদ্ধ জয়ের অংশীদারিত্বও যে আপনা আপনি চলে যায়, সেটি কি ৭২ এর সংবিধান প্রনেতারা বোঝেন নাই? উনারা ঠিকই সেটা বুঝেছিলেন এবং জানতেন।

তাহলে তারপরও কেন 'যুদ্ধ'কে 'সংগ্রাম' লেখা হলো?
এটা লেখা হয়েছিল মূলত: দুইটি কারণে। প্রথমত: যুদ্ধে অংশ না নেয়া শেখ মুজিব হতে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল কৃতিত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকে তাদের চেয়ে পেছনে রাখতে। দ্বিতীয়ত: চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে যুদ্ধবিজয়ীর একক কৃতিত্ব দিতে।

স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা এবং বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন, তখন পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এই ভুল তথ্য শুধরে দিয়ে লেখা হয়- 'ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি'।
কিন্তু বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুলের রায় এবং ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আবারো সেটা বদলে দিয়ে লেখা হয়- 'ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি'। অর্থাৎ আবারো নিজেদের যুদ্ধ বিজয়ের অংশীদারিত্বকে সাংবিধানিকভাবে অস্বীকার করা হয় কেমবলমাত্র যুদ্ধে অংশ না নেয়া কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল কৃতিত্ব দিতে।

বাংলাদেশ যখন সাংবিধানিকভাবে তাদের নিজেদের জয় করা যুদ্ধকে অস্বীকার করে; যুদ্ধ বিজয়ে নিজের অংশীদারিত্ব ত্যাগ করে, তখন ভারত কেন এই সুযোগ লুফে নিয়ে যুদ্ধ বিজয়ের একক কৃতিত্ব দাবী করবে না?

কাজেই ১৬ ডিসেম্বরকে ভারত কর্তৃক এককভাবে তাদের বিজয় দিবস দাবী করার কারণে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের আগে নিজেদের নেতাদের জিজ্ঞেস করুন- কেন তারা জয় করা 'যুদ্ধ'কে 'সংগ্রাম' বানিয়ে যুদ্ধ বিজয়ে নিজেদের অংশীদারিত্ব ভারতের হাতে তুলে দিলো।

Sunday 1 October 2017

সামিয়া ও মারজানের আরো একটি গবেষণা প্রবন্ধে মেধাচুরির প্রমান!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান ও অপরাধবিজ্ঞান (ক্রিমিনোলজি) বিভাগের বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে অন্যের গবেষণা নিজেদের নামে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্ত কমিটি গঠনের পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ধরণের আলোচনা হচ্ছে।

কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, অভিযুক্ত এই দুই শিক্ষক ‘A New dimension of Colonialism and Pop Culture: A case study of the Cultural Imperialism’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লেখেন যা গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউ’-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

ওই প্রবন্ধের বিরুদ্ধে 'মেধাচুরি'র অভিযোগ আনে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস। তাদের অভিযোগ, প্রবন্ধের সিংহভাগ নেওয়া হয়েছে প্রখ্যাত দার্শনিক মিশেল ফুকোর প্রবন্ধ ‘The Subject and Power’ থেকে যা ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো প্রেস জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এই অভিযোগের পর সামিয়া রহমান দাবী করেছেন, ঐ প্রবন্ধটি লেখা এবং প্রকাশের জন্য উপস্থাপনের সময় তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন বিধায় এই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। প্রবন্ধের সহ-লেখক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান তাকে না জানিয়েই এই প্রবন্ধটি তৈরী করেছিলেন এবং সেই কারণে এই প্রবন্ধের কোন দায় দায়িত্ব তিনি গ্রহন করবেন না।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- এই দুই শিক্ষকের আরো একটি প্রবন্ধে মেধাচুরির প্রমান মিলেছে!

২০১৩ সালে এই দুই শিক্ষক Journal of Mass Communication & Journalism এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল, Role of Mass Media in Setting Agenda and Manufacturing Consent:A Study on Wars to Rise of Radical Group (Hefajat-e-Islam) in Bangladesh। এই প্রবন্ধটিকে সামিয়া রহমান তার নিজের কাজ হিসেবে ব্যক্তিগত ওয়েব সাইটে উল্লেখ করেছেন। এমনকি Journal of Mass Communication & Journalis এর ওয়েব পেজেও এই লেখাটির করসপন্ডেন্ট অথর হিসেবে সামিয়া রহমানের নাম-ঠিকানাই লেখা রয়েছে।

আলোচ্য প্রবন্ধে তারা মোট ১২টি রেফারেন্স ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু প্রবন্ধটি পড়ে দেখা যায় এই ১২টি রেফারেন্সের বাইরে তারা আরো কমপক্ষে আরো সাত (৭) টি লেখা থেকে সরাসরি কিছু অংশ কপি-পেস্ট করেছেন কিন্তু সেগুলোর কোন রেফারেন্স দেন নাই। অর্থাৎ ঐ অংশগুলো অন্যের মেধাচুরি করে লেখা হয়েছে।

প্রবন্ধটির মেথডলজি অংশের প্রথম প্যারাগ্রাফের দ্বিতীয় লাইন থেকে শুরু করে বাকি অংশের পুরোটাই নেয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের স্কুল অব ইনফরমেশনের The Historical Approach to Research থেকে, যার কোন রেফারেন্স লেখকদ্বয় দেন নাই।


প্রবন্ধটির What is public opinion? উপ-শিরোনামের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের নীচর অংশটি তারা হুবহু এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার Public opinion এন্ট্রির প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকে নিয়েছেন এবং যথারীতি কোনরূপ রেফারেন্স না দিয়ে।

উপাত্ত সংগ্রহ ও নমূনায়ন অংশে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বর্ননা অংশে লেখকদ্বয় মাঝামাঝি দু'টি লাইন নিয়েছেন Soldier's Walk নামে একটি ওয়েব পেজের ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর লেখা The War In VietNam অধ্যায় থেকে।






ঐ একই প্যারাগ্রাফের নীচের অংশটি তারা নিয়েছেন Fallout Wiki এর Vietnam War অংশ থেকে। বলাবাহুল্য এই এক প্যারাগ্রাফ লিখতে তারা দুইটি ভিন্ন লেখা থেকে কয়েকটি করে লাইন সরাসরি লিখলেও যথারীতি সেগুলোর কোন রেফারেন্স দেননি।



২০০১ সালের ৯/১১ এর টুইন টাওয়ারে হামলার উপর লেখা বর্ননার প্রথম লাইনটি বাদে বাকী অংশ হুবহু উনারা তুলে দিয়েছেন BBC NEWS | In Depth এর The four hijacks শিরোনামে লেখা নিবন্ধের প্রথম প্যারাগ্রাফ থেকে।

ইরাক যুদ্ধের অংশের উপর লেখা প্যারাগ্রাফের প্রথম অংশটি উনারা নিয়েছেন Timeline Index ওয়েব পেজের The Iraq War 2003 থেকে।

এই প্যারাগ্রাফের শেষ অংশটি উনারা সরাসরি কপি করেছেন উইকিপিডিয়ার Iraq and weapons of mass destruction এন্ট্রি থেকে। বলাবাহুল্য, কোনটির ক্ষেত্রেই উনারা কোন রেফারেন্স দেন নাই।



এভাবে একটি গবেষণা প্রবন্ধে উৎস উল্লেখ না করে সরাসরি অন্যের লেখাকে কপি-পেস্ট করে ব্যবহার করা খুবই অনৈতিক একটা কাজ। সামিয়া রহমান এবং মাহফুজুল হক মারজান সেই অনৈতিক কাজটিই করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, লেখাটি যে জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সেটির রিভিউয়াররা এই সাত (৭) টি মেধাচুরির ঘটনাকে হয় সনাক্ত করতে চান নাই, অথবা সনাক্ত করতে পারেন নাই।

বর্তমানে যে কোন ক্রিয়েটিভ লেখালেখির ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য এবং লেখার মধ্যে অন্য কারো লেখা রেফারেন্সবিহীনভাবে ব্যবহার করার বিষয়টি সনাক্ত করার জন্য বেশ কিছু সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়। আমাদের মত ছা-পোষা লেখকরাও ঐসব সফওয়ার ব্যবহার করে নিজেদের লেখাকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করি। যারা বিভিন্ন জার্নালে রিভিউয়ার বা প্রফেশনাল এডিটর হিসেবে কাজ করেন, তারা তো বটেই এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এইসব সফটওয়ার ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট, টার্মপেপার বা থিসিস যাচাই করে থাকেন। কাজেই Journal of Mass Communication & Journalism এর এডিটর ও রিভিউয়াররা এই সফওয়ারগুলো ব্যবহার করেন না, এটা মেনে নেয়া কঠিন।

আশা করি বাংলাদেশের শিক্ষক-গবেষক এবং এডিটর-রিভিউয়াররা আরেকটু সতর্ক হবেন এবং মেধাচুরি'র মত গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকবেন।

Thursday 10 August 2017

এ বি এম খায়রুল হক আদলত অবমাননার মাধ্যমে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন


অবসরের পর দেয়া বিতর্কিত রায় থেকেই সংকটের শুরু
একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কিংবা একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যদি তার অবসর গ্রহনের ১৬মাস পর চাকুরিকালীন সময়ে তারজন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্রটি আবারো ব্যবহার করতে চান সেটি কি আইনগতভাবে বৈধ হবে? হবে না।

ঠিক তেমনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১৯৮৮ সালের বিধি অনুযায়ী একজন বিচারককে রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। যার ফলে অবসরের পর রায় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সেই অপকর্মটিই করেছিলেন।

২০১১ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের আদেশের সময় প্রকাশ্য আদালতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, পরবর্তী আরো দুইটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা যেতে পারে। অথচ সেই রায়ের লিখিত আদেশ তিনি প্রদান করেন তার অবসর গ্রহনের ১৬ মাস ১সপ্তাহ পর। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে- সেই লিখিত রায় লেখার সময় তিনি ইতিপূর্বে আদলতের রায়ে দেয়া তার আদেশ 'পরবর্তী আরো দুইটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজন করা যেতে পারে' অংশটি বাদ দেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তিনি এই রায় লিখে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়ে ঐ দলটিকে নির্বাচনবিহীনভাবে দেশ পরিচালনার অবৈধ ও অগনতান্ত্রিক অসদুপায় অবলম্বনের পথ তৈরী করে দেন।

বিতর্কিত রায় আগেও দিয়েছেন
আদালতকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহারের দৃষ্টান্ত এ বি এম খায়রুল হকের জন্য এটাই প্রথম নয়। এর আগেও তিনি এভাবে অপ্রাসঙ্গিক বিতর্কিত আদেশের মাধ্যমে আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন। শেখ মুজিবের আমলে 'মুন সিনেমা' হলকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রাষ্টের মালিকানায় নেয়া হয়েছিল, যার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সরকারগুলোর আমলেও বহাল ছিল। সেই সিনেমা হলের ক্ষতিগ্রস্থ মালিক ঐ সম্পত্তির মালিকানা ফিরে পাবার জন্য আদালতের দারস্থ হন।

সেই সিনেমা হলের মালিকানা ফিরে পাবার আর্জিতে বাদী কোন সরকারের আমলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন  তোলেন নাই। কিন্তু বিতর্কিত বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ঐ মামলার রায় প্রদানের সময় সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিকভাবে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল ঘোষনা করেন এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষনা করেন। সেটিই ছিল আদালতকে ব্যবহার করে অপরাজনীতির প্রথম দৃষ্টান্ত।

অথচ- সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিচার বিভাগকে স্বাধীনতা দেবার এবং বিচারপতিদের মর্যাদা ও চাকরীর মেয়াদ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া ছিল সংসদের হাতে আর শেখ মুজিবের ৪র্থ সংশোধনীতে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতির (শেখ মুজিবের) হাতে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই ক্ষমতা দেন বিচারকদের প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে। এর ফলে বিচারকরা রাস্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার অধিকার পান। শেখ মুজিবের ৪র্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে শপথ গ্রহন করানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে। ৫ম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেই দায়িত্ব অপর্ন করেন প্রধান বিচারপতির কাছে। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান 'রাষ্ট্রপতি'কে প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ৫ম সংশোধনীতে অন্তর্ভূক্ত করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিচারপতিদের সম্মানকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন। এখানেই শেষ নয়; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীতে বিচারকদের অবসর গ্রহনের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের চাকরীর মেয়াদও বৃদ্ধি করেন।

গোস্ত হারাম কিন্তু ঝোল হালাল!
মুন হলের মালিকানা নিষ্পত্তির রায়ে বিতর্কিত বিচারক এ বি এম খায়রুল হক যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামল এবং তাঁর দেয়া ৫ম সংশোধনী বাতিল করার রাজনৈতিক আদেশ প্রদান করেন, তখন তিনি তার ভাষায় 'অবৈধ সরকার' এর আমলে দেয়া বিচারপতিদের সম্মান ও সুবিধাগুলো কিন্তু রদ করেন নাই। তিনি কিন্তু বলেন নাই যে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেবার সিদ্ধান্তটি 'অবৈধ' ছিল; তিনি বলেন নাই যে, প্রধান বিচারপতির কাছে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহনের সিদ্ধান্তটি 'অবৈধ' ছিল এবং সেই অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেয়া পরবর্তী সকল রাষ্ট্রপতিরা 'অবৈধ' ছিল; তিনি একথাও বলেন নাই যে, তার ভাষায় 'অবৈধ' প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তার (খায়রুল হকের) রায়ে 'অবৈধ' ঘোষিত সংবিধানের ৫ম সংশোধনী অনুযায়ী বর্ধিত মেয়াদে চাকরী করা বিচারপতিদের দেয়া আদেশগুলো 'অবৈধ' ছিল, এমনকি বর্ধিত চাকরী মেয়াদে বিচারপতিদের নেয়া বেতন-ভাতা 'অবৈধ' ছিল।

এই বিতর্কিত বিচারপতি খায়রুল হক নিজেই তার একটি রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, বিচারপতি'র পদ থেকে অবসর গ্রহনের পর কোন বিচারক তার পেনশন ও প্রাসঙ্গিক ভাতা বাদে আর কোন রাষ্ট্রীয় সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রের কোন লাভজনক পদ গ্রহন করতে পারবেন না। কিন্তু নিজের সেই আদেশ নিজেই লঙ্ঘন করে তিনি অবসর গ্রহনের পর গরিব জনগণের জন্য সংরক্ষিত ত্রাণ তহবিলের কয়েক লক্ষ টাকায় বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন এবং রাষ্ট্রের লাভজনক 'আইন কমিশনের চেয়ারম্যান' পদ গ্রহণ করেছেন।

রাজনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী খায়রুল হকের বিতর্কিত রায়
সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। সেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ অবরুদ্ধ করে দিয়ে একটি স্বৈরাচারী সরকারকে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য অবসর গ্রহণের ১৬ মাস ১সপ্তাহ পরে বিতর্কিত রায় দিয়ে বাংলাদেশের গনতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার হরণের কালো অধ্যায়ের পথ তৈরী করে দিয়েছিলেন এই খায়রুল হক। সেই সময় থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার এবং গনতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা কয়েক শত মানুষের গুম-খুনের জন্য দায়ী এই বিচারপতি খায়রুল হক।

আদলত অবমাননার বিচার হওয়া জরুরী
এখন খায়রুল হক তার সেই বিতর্কিত রায়ের বিষয়ে সংবিধানের ১৬'শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চের রায়ের সমালোচনা করছেন বেআইনী ভাষায়! সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া একটি রায়কে তিনি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ঐ রায় প্রদানকারী বিচারকদের 'ইমম্যাচিউরড' বলে কটাক্ষ করেছেন, রায়টির পর্যবেক্ষণসমূহকে 'সঠিক নয়' বলে ঘোষনা করেছেন, এই রায়কে 'পূর্ব ধারণাপ্রসূত' ঘোষণা করেছেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে 'বিচারকদের প্রজাতন্ত্র' হিসেবে কটাক্ষ করে আদালত এবং প্রজাতন্ত্রকে অপমান করেছেন।

খায়রুল হকের এই প্রতিটি কাজ সুষ্পষ্টভাবে আদালতের অবমাননা এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বাংলাদেশের আদলত এর আগে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানসহ অনেক ব্যক্তিকে এরচেয়েও তুচ্ছ কারণে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি প্রদান করেছে। এখন জনগণ দেখতে চায়, সর্বোচ্চ আদালত, তার রায় এবং বিচারপতিদের নিয়ে প্রকাশ্যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা খায়রুল হককে আদালত অবমাননার জন্য শাস্তি দেয়া হয় কিনা।

উল্লেখ্য যে, এর আগেও আবুল মাল আব্দুল মুহিত উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের চরমভাবে অসম্মান করে বক্তব্য দিয়েছেন। তার দেখাদেখি ক্ষমতাসীন দলের আরো নেতারা আদালতকে অবমাননা করে বক্তব্য দিয়েছেন।

এইসব আদালত অবমাননার বিচার না হলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌছাবে। জনগণের মধ্যে আদালতের সক্ষমতা ও শাস্তিপ্রদানে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরী হবে। জনগণ মেরুদণ্ডবিশিষ্ট বিচারক দেখতে চায়। আজ যদি এইসব আদালত অবমাননাকারীদের বিচারের সমূক্ষীণ না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আদালত অবমাননাকারীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। সেই সময় তাদের বিচার করতে গেলে আজকের বিচার না করাদের বিষয়টি তখন উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হবে।

Thursday 1 June 2017

বিমান টিকিটে দ্বিগুণ শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রবাসী শ্রমিক এবং দেশের রেমিটেন্স

আবুল মাল আব্দুল মুহিতের দেয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিমান ভ্রমনের উপর কর দ্বিগুন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বাজেট বক্তব্যে উনি বলেছেন আকাশপথে যাত্রী পরিবহন বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই এটি রাজস্ব আয়ের একটি সম্ভাবনাময় খাত!

উনার প্রস্তাব মোতাবেক: "অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও সার্কভুক্ত দেশের বিমানের টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে অন্যসব ক্ষেত্রে দ্বিগুণ শুল্ক আরোপ করা হবে। বর্তমানের মতো অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও সার্কভুক্ত দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্স টিকিটের ওপর আবগারি শুল্কের পরিমাণ ৫০০ টাকায় অপরিবর্তিত থাকবে। তবে সার্কভুক্ত দেশ ব্যতীত এশিয়ার অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১ হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা শুল্ক কাটা হবে।

এছাড়া ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে শুল্ক হার হবে তিন হাজার টাকা। এয়ারলাইন্স টিকেটের সঙ্গে এই শুল্ক আদায় করতে হবে।
"

এবার আসুন উনার এই শুল্ক প্রস্তাবে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেটা বোঝার চেষ্টা করি।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ভ্রমনে কেবলমাত্র উচ্চমধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরাই আকাশপথ ব্যবহার করে থাকেন; দেশের মধ্যবিত্ত আর নিম্মবিত্তদের ভরসা এখনো বাস, ট্রেন আর লঞ্চে। অন্যদিকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যাতায়াতকারী যাত্রীদের ৮৭% এর গন্তব্য ভারত (২০১৩ সালের হিসাব), এর পরেই নেপালের অবস্থান। এই দুই দেশে যাতায়াতকারীদের মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্ত, তারাও সড়কপথ বা রেলপথই ব্যবহার করেন, কেবলমাত্র উচ্চমধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরাই আকাশপথে এই দুই দেশের যাত্রী। এই দুই দেশে বাংলাদেশের কোন শ্রম বাজার নেই। বরং বাংলাদেশে ভারতের প্রায় ৮ লাখ লোক চাকুরী ও ব্যবসা করে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রম বাজারের বড় অংশই মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে। এই শ্রমিকদের রক্তপানি করা বৈদেশিক মূদ্রা বিদেশে পাচার করে 'অর্থ রফতানীকারক দেশ' হিসেবে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। এখন এই শ্রমিকদের রক্ত সরাসরি চুষে খাবার জন্য তাদের বিমান ভ্রমনের উপর কর বসানো হচ্ছে।

মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে যদি সমূদ্রপথে কম খরচে যাওয়া যেত, তাহলে এই শ্রমিকরা সেই পথেই যেত; যেমনটা তারা ঢাকা-বরিশাল যাতায়াতের সময় লঞ্চের ডেকে কিংবা ঢাকা-রংপুর যাতায়াতের সময় বাসের ছাদে চড়ে। নিতান্ত নিরুপায় হয়েই শ্রমিকরা বিদেশে তাদের কর্মস্থলে আকাশপথে যাতায়াত করে।

কাজেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং সার্কভূক্ত দেশে আকাশভ্রমনের শুল্ক বৃদ্ধি না করে অন্য দেশে আকাশপথে ভ্রমণের উপর শুল্ক দ্বিগুন করলে এর চাপটা পরবে ঐ গরিব শ্রমিকদের উপর। এই শ্রমিকদের উপর চাপ পরলে সেটা ফলে দেশের রেমিটেন্স আয়ের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পরবে।

আবুল মাল আব্দুল মুহিত আক্ষরিক অর্থেই একটা গরিব মারা বাজেট দিয়েছেন।

Wednesday 26 April 2017

দুর্নীতির বাঁধ ভেঙে হাওরে বন্যা এবং হাসিনার অপরাজনীতি



আকষ্মিক বন্যায় বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকার কারণে হাওর অঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ তাদের ফসল, মৎসসম্পদ, হাঁস-মুরগী এবং গবাদীপশু হারিয়েছে। সরকারী হিসেবেই দুই লাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে যা থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যেত। এছাড়াও এক হাজার ২৭৬ মেট্রিক টন মাছ নষ্ট হয়েছে এবং তিন হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা গেছে। বলাবাহুল্য, সরকার সব সময় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান কমিয়েই বলে। এমনকি এই কমিয়ে বলার পরও হাওরে ক্ষতির পরিমান প্রচারে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব নির্মান সামগ্রী দিয়ে অবকাঠামো নির্মান করতে দেখা যায় এবং তাতে যে ধরণের দুর্নীতি হয় তা আমলে নিলে এটি অবশ্যই বোঝা যায় যে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মান, মেরামত এবং রক্ষনাবেক্ষণে ত্রুটি ছিল; যে কারণে বাঁধ ভেঙেছে। কাজেই দুর্নীতির কারণে এই বাঁধ ভাঙার মাধ্যমে হাওর অঞ্চলের ৪০ লক্ষ মানুষ নিস্বঃ হয়ে যাবার দায় এককভাবে সরকারের।

হাওর অঞ্চলে বাঁধ ভেঙে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পক্ষে যখন দেশের সচেতন মানুষ এবং রাজনীতিবিদরা দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন, তখন শেখ হাসিনা এবং তার দলের নেতাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হলো- 'হাওরের বন্যা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে'! বটে! দুর্নীতি করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নষ্ট করলেন আপনারা, সেই কারণে বাঁধ ভেঙে ৪০ লক্ষ মানুষ যখন সহায় সম্বলহীন হয়ে গেল, তখন তাদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে সেটা পাপ হয়ে গেল! রাজনীতিবিদদের কাজই তো হচ্ছে জনগণের পাশে তাদের আপদ বিপদে দাঁড়ানো। এভাবে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করাই তো আদর্শ রাজনীতবিদের আচরণ।

এখন আবার প্রশাসনকে দিয়ে আদেশ দেয়ানো হয়েছে আগামী ৩০ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে বেসরকারী কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা যাবে না। অর্থাৎ, এই সময়ে কেবলমাত্র সরকারী দলের লোকজনই ত্রাণকার্য পরিচালনা করবেন। নিজেই সর্প হয়ে দংশন করেছিলেন, নিজেই ওঝা হয়ে ঝাঁড়বেন!

মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ঘোষণা দিয়েছেন, হাওরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬ জেলার ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে আগামী ১০০ দিন পর্যন্ত মাসে ৩০ কেজি করে বিনামূল্যে চাল ও ৫০০ টাকা অর্থসহায়তা সহায়তা দেওয়া হবে।

ক্ষতিগ্রস্থ হলো ৪০ লক্ষ মানুষ, আর উনারা সহায়তা দেবেন তার এক চতুর্থাংশকে, বাকীরা কোথায় যাবে? কী খাবে? সবচেয়ে বড় কথা- ৩০ কেজি চালে একটি পরিবারের তো ১০/১৫ দিনের বেশি চলবে না। মাসের বাকী দিনগুলো কী তারা না খেয়ে থাকবেন? ৫০০ টাকা দিয়ে একটি পরিবারের ৫ দিনের খরচও তো মেটানো সম্ভব না।

সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে যে অর্থ এবং ত্রাণ সাহায্য দেয়া হয়েছে বলা হচ্ছে- তার বেশিরভাগই এখনো অনেক এলাকায় পৌছেনি। যেটুকু পৌছেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এমনকি খোলা বাজারে বা ওএমএসএ যে চাল বিক্রি করা হচ্ছে তাও সবাই পাচ্ছেন না।

শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতির কারণে বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ ভেঙে ফসল নষ্ট হলো, মাছ-হাঁস-গবাদীপশু হারিয়ে হাওরের মানুষ নিস্বঃ হয়ে গেল। অথচ উনারা ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে নিজেরাও দাঁড়াচ্ছেন না, অন্যদেরও দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। এমনকি মিডিয়া সেন্সরশিপের মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের প্রকৃত তথ্যও প্রকাশ করতে দিচ্ছেন না।

নিজেদের দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দেবার মাধ্যমে হাসিনা সরকার যা করছেন, এটাকে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বললেই ভাল হয়।

Monday 3 April 2017

Paradoxical IPU: Bangladesh case



Bangladesh is observing the 136th Assembly of the Inter-Parliamentary Union (IPU) from April 1 to 5 of 2017. IPU is the world organization of Parliaments. And according to its statutes, it is the “focal point for worldwide parliamentary dialogue” and works “for peace and co-operation among peoples and for the firm establishment of representative institutions”. Thus, citizens of Bangladesh had high expectations for IPU support for their democratic rights. But the ground realities in Bangladesh are such that the IPU, due to its current presidency, is not aware of Bangladesh’s pains.
The serving IPU President Saber Hossain Chowdhury himself is among those 153 members of parliament (out of 300 constituencies) who were elected unopposed in the “electoral coup” on January 05 of 2014, on which the US Department of State commented, “deeply flawed”. Over half of Bangladeshi citizens reft the right to vote to elect their representative in Parliament. Mr. Chowdhury also missed the opportunity to vote himself like 152 other members of parliament. Even the head of state, head of government and head of parliament did not have an opportunity to vote.
Forcing all the registered and eligible political parties except for only 14 parties that are allied with Awami League through the abolishment of the globally accepted “non-party caretaker government” system, in the controversial January 05 election, Awami League-led government grasp the power unchallenged.
The overall human rights situation has deteriorated, and the scale of extrajudicial deaths and enforced disappearances has increased as a disaster as the ultimate result of the absence of democracy.
When the delegates of IPU were arriving to participate in its 136th conference to discuss on reducing inequalities in Bangladesh, detective branch men picked up a youth on March 29 from his home in the port city Chittagong of the country. He was found dead on the riverbank of Karnafuli within 12 hours with marks of torture all over his body and three bullet shots in his head. His entire fault was that he supported a party that opposes the views of Bangladesh’s ruling party Awami League.
And this is not the only incident. Starting from Chowdhury Alam, a metropolitan BNP leader, law-enforcing agencies have abducted more than five hundred civilians, and most of them never returned. The very day this IPU conference started an internationally recognized local human rights organization Ain of Salish Kendra confirmed that 25 people were similarly picked up in the first three months of the year and 59 people have been killed in the custody of law enforcers.
Unfortunate enough, the organization that according to their statement, guarantees people’s rights and liberties and works to secure peace and development, is holding its 136th conference in a country that has distanced itself far from the stance to ensure people’s right to live, let alone other rights including liberties.
And it is not a matter of last three months, rather the systematic annihilation of people with dissenting views has been continuing since 2009, which become a regular practice since the January 5 Parliament election of 2014.
Demolishing the democratic institutions, which are according to IPU, “critical to democracy” did not end on January 05 of 2014 in Bangladesh by Awami League; rather they found a new momentum. After that electoral farce, the government led by Awami League systematically amputated the local government institutions including the Upazila Parishad, Union Parishad, and City Corporations. Violence became an integral part of each of the elections.
At least twenty-one people were killed in the January 05 national election due to the police excesses. The killing spree continued in the Upazila Parishad polls where around sixteen people were brutally murdered. 
But the Union Parishad, the smallest unit of local government saw the most violence. Immediately after the announcement of the Union Parishad elections in February 2016, violence started across the country. As of June 14, 2016, 116 people were killed and 8000 injured due to the violence related to the Union Parishad polls.
Furthermore, the ruling Awami League did not stop at not letting the opposition men winning in the elections, and they started suspending the elected representatives on vague charges who got elected by popular vote from opposing groups, mostly from BNP. The very moment the IPU conference is taking place; the government has suspended three mayors from three city corporations. They are among those two hundred elected representatives who have been suspended by the government.
The violence resulted in fear among the common mass who refrained themselves from voting to save their lives which enabled the ruling party cadres to rig the election in every possible manner starting from stuffing, snatching ballots and so on.
Today, it is evident that all these events that followed the January 05 polls including the gross human rights abuse, demolishment of democratic institutions, and violence on vote days and patronized vote rigging, were inter-linked only to create fear among the voters who may vote against the Awami League.
However, the worst part of this mockery of democracy was yet to take place. Amid pieces of evidence of state-sponsored demolishment of the democratic institutions, within ten months of getting elected by an election, which was termed as an electoral farce by The Economists, a parliamentarian from Awami League managed to get elected as the head of Inter-Parliamentary Union.
Notwithstanding, the people of Bangladesh expected that the world leaders and the organization IPU, itself would change the venue considering the ineligibility of the government in Bangladesh that lacks popular support and has gone desperate to weaken the foundations of democracy, the IPU that claims to have given “priority to prevent and eliminate conflict through political dialogue” itself violated its statement by letting Bangladesh host the 136th Inter-Parliamentary Union conference.
This is a shame for the organization itself that it has designated a government to hold the conference that is blamed for being authoritarian and violent towards dissenting voice. The legitimacy and effectiveness of the IPU will also be under serious question after this conference.

Wednesday 29 March 2017

ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র জন্য শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে দোষি সাব্যস্ত করলো এফবিআই!


যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা পাচারের নেপথ্যে ছিল ‘রাষ্ট্রীয় মদদ’; বলছেন ওই ঘটনার তদন্তে ফিলিপাইনে থাকা এক এফবিআই কর্মকর্তা। এ ব্যাপারে বিস্তারিত না জানালেও এফবিআই  রিজার্ভ চুরির হোতাদের নাম-পরিচয় খুব শীঘ্রই প্রকাশ করবে বলে তিনি জানিয়েছেন

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় পাচার করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ এক মাস গোপন রাখার পর ফিলিপাইনের মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়। প্রথমে এই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগের নেতারা পাকিস্তানী এবং চীনা হ্যাকারদের দায়ী করলেও গত ২২ মার্চ ২০১৭ তারিখে ভারতীয় সাংবাদিক অরুণা বিশ্বনাথা এবং চীনা বংশোদ্ভুত মার্কিন সাংবাদিক নিকোল হংগ ওয়ালস্টিট জার্নালে একটি প্রতিবেদন লিখে এফবিআই এর অসমর্থিত সূত্রের উল্লেখ করে দাবী করে যে এই ডিজিটাল 'ব্যাংক ডাকাতি'র সাথে উত্তর কোরিয়া জড়িত! একই দিন রয়টারও ওয়ালস্টিট জার্নালের সেই প্রতিবেদনের রেফারেন্স দিয়ে একই দাবী করে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের সরকারী, সরকার সমর্থক এবং সরকারী চাপে থাকা সকল মিডিয়া সমস্বরে এই সংবাদ ব্যানার হেড করে।

দেশি-বিদেশী সকল মিডিয়াতেই বিশ্বনাথা-হংগ এর বরাতে দাবী করা হয় "বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) উত্তর কোরিয়াকে দায়ী করার পর এই দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করছে যুক্তরাষ্ট্রেরই ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। মার্কিন আইনজীবিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির পেছনে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।"

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই চাঞ্চল্যকর রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এ ঘটনায় ঊর্ধ্বতন ২ কর্মকর্তা সরাসরি জড়িত।

শুধু তাই নয়, গত ২৬ জুলাই ২০১৭ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এর তদন্ত প্রতিবেদনের রেফারেন্স উল্লেখ করা হয়, "রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান সুইফট এবং ভারতীয় একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান জড়িত। ওয়ার্ল্ড ইনফরমেটিকস নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা।" উল্লেখ্য যে, এই রাকেশ আস্তানাকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তার জন্য উচ্চ বেতনে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। এই ঘটনাকে 'ইনসাইড জব' উল্লেখ করার কারণে সরকারের সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তানভির হাসান জোহাকে কয়েকদিনের জন্য গুম করেছিল কোন একটি গোয়েন্দা সংস্থ্যা

গত ২৩ মার্চ ২০১৭ তারিখ বিবিসি বাংলা "রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে ফিলিপিনের ইনকোয়ারার পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাক্সিম লুকাস, যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রথমে বিস্তারিত ফাঁস করে ব্যাপক আলোড়ন তোলেন, তার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, "বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে ফিলিপিনের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রিজার্ভ চুরির হোতারা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে আছে"।

বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদন প্রকাশের দুই ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ১৪ তলায় বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগে, যেখান থেকে ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে রিজার্ভ লুটের ঘটনা ঘটেছিল এবং যেখানে রিজার্ভ লুটের আলামত ছিল সেখানে রহস্যজনকভাবে আগুন লাগে

এই রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান সমরেন্দ্র নাথ বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ জায়গায় আগুন লাগার কথা নয়৷ ব্যাংকের ভেতরে এটাই প্রথম আগুন, যা নিভাতে ফায়ার সার্ভিসকে যেতে হয়েছে"৷

এই বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, "অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তা কিংবা কেউই ফায়ার সার্ভিস অফিসে টেলিফোন করেননি। স্থানীয়রাই আমাদের খবর দেন। তারপর ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের প্রায় ৭০ জন কর্মী যান ঘটনাস্থলে।"

প্রশ্ন অনেকগুলো:
১/ যেখানে ফিলিপাইনে এই বিষয়ক প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে এবং শুনানীও হয়েছে প্রকাশ্যে, সেখানে কী কারণে ড. ফরাসউদ্দিনের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি?
২/ সিআইডির করা প্রতিবেদনও কেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি?
৩/ যে রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যাংক ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্ট বলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে সিআইডি, সেই রাকেশ আস্তানাকেই কেন আবার এই ব্যাংক ডাকাতির বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হলো?
৪/ কী কারণে জোহাকে গুম করে তার মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো?
৫/ বিবিসিতে প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঐ বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগেই আগুন লাগলো এবং সেই আগুন নেভানোর জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন ফায়ার সার্ভিসে খবর দিল না?

এই প্রশগুলোর উত্তর না পাওয়া থেকে একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা এই ঘটনার সাথে জড়িত, তাদের নাম প্রকাশ পেলে সেই সূত্র ধরে সরকারের এমন কোন শীর্ষ ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়ে যাবে যেটা নিয়ে খোদ সরকার ভীষণ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পরবে। এই ব্যাংক ডাকাতির নাটাই যদি ঐ কর্মকর্তাদের হাতে থাকতো, তাহলে সরকার তার গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জোহাকে গুম করানোর ঝুঁকি নিত না, সরকারী তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়েও রাখতো না এমনকি অভিযুক্ত রাকেশ আস্তানাকেই আবার তদন্ত করার দায়িত্ব দিত না।

এফবিআইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে জেলের ভাত খাওয়ানো যায় কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডাকাতির তথ্য প্রকাশ করলে শুধু এফবিআইকে গালি দেওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করা যায়? বড়জোর সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আগুন ধরিয়ে সমস্ত প্রমাণাদি বিনাশ করা যায়! এতোটুকুই কি যথেষ্ট নয়?

Saturday 18 March 2017

Damages of development!

Bangladesh's one the most famous novelist, Humayun Ahmed, once compared Bangladeshis with Gold Fish for forgetting things too quickly. Differing with the famous author and keeping faith upon Bangladeshis, I would like to believe that they have not forgotten what happened in Bahaddarhat of Chittagong, five years back. Three girders of the infamous Bahaddarhat flyover claimed at least thirteen lives in the November of 2012.

This fatal incident was followed by a series of similar casualties in Sirajganj, Patuakhali, Pirojpur, Boalkhali, and only a few days back in Malibagh of capital Dhaka. The number of deaths has crossed the two dozen mark so far.

To understand the fatal deaths one does not require having excellent research skills. Among the common reasons, lack of safety maneuver, unawareness, and inexperience would come to fore. But if it is asked why the 'middle income' country that can even afford one of the most expensive highways and bridges in the world, could not ensure proper safety for its citizens while making them, it is pretty evident that the issues of political interventions must outpace all other reasons.

After the incident of Bahaddarhat, influential Awami League leader from Chittagong, ABM Mohiuddin Chowdhury publicly held the Treasurer of Chittagong Awami League, also the Chairman of Chittagong Development Authority Abdus Salam responsible for the loss of lives. It was alleged that, with the abuse of power, Mr. Salam awarded the construction work to the people of his choice who messed up everything that caused the girders to fell. After the catastrophe, the military was called to complete the unfinished flyover.

Surprisingly, after a set of interesting turn of events, Abdus Salam was dropped from the charge sheet placed by police over the incident, and his term was extended for two more years in 2015.

Leaders are said to have lead by examples, not by orders. The example that was set by this incident was clear as a bell: if you are with us, you need not worry, no matter how many lives are gone due to your negligence.

And the results are now in hand. Last year in June, a one-month-old bridge was collapsed and caused the death of one in Pirojpur. And now, similarly in the capital, the girder of a flyover that is yet to be built took the life of a woodcarver.

Political interference, sheer negligence, lack of willingness to monitor, high cost per unit and the use of low-quality equipment were much evident in near past. Infighting between Awami League men for construction works, incidents, like using bamboo instead of rods, and awarding development projects to Awami League men, have been very common. According to a popular Bengali-language daily, the company that is supervising the construction work of the Malibagh flyover is owned by a state minister of the government.

Awarding these contracts to partisan developers usually, results in three types of problems that have become the open secret to some extent. First of all, they often lack the experience to build such large-scale structures and care a little about public safety.

Secondly, after winning the contract, they secretly transfer that to some other construction firm making sure that their profit is gained. These companies losing a portion of the money to those leaders try to make the project cost effective and use low-quality equipment for making a profit out of that.

Thirdly, these constructors willingly use low-quality equipment or do not use sufficient materials while constructing those structures to (or “intending to”) making handsome profits, leaving those structures in an unsafe condition.

While on the other hand, the voices against such misconducts are being silenced by terming them 'anti-development' or 'enemy of development', a phenomenon mostly used by government high-ups nowadays.

Many may call these deaths accidents, mistakes and so on, but if we ask our conscience, are all these deaths can just be termed as 'accident'?


উন্নয়নের ক্ষয়-ক্ষতি!

সবকিছু দ্রুত ভুলে যাবার প্রবনতার কারণে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের জনগণকে গোল্ডফিসের সাথে তুলনা করেছিলেন। খ্যাতনামা সেই সাহিত্যিকের সাথে দ্বিমত পোষন করে বাংলাদেশের জনগণের উপর আস্থা রেখেই আশা করছি, পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট কী ঘটেছিল, সেটা তাদের মনে আছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে কুখ্যাত বদ্দারহাট ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধ্বসে ১৩ (তের) জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

এই ভয়াবহ ঘটনার পরবর্তী একের পর এক এমন নির্মানাধীন উন্নয়ন অবকাঠামো ধ্বসে সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, বোয়ালখালীসহ আরো কয়েক জায়গায় মানুষের মৃত্যুর পর সম্প্রতি গত ১৩ মার্চ মালিবাগে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসের ঘটনায় সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা দুই ডজন অতিক্রম করেছে।

এইসব মৃত্যুর কারণ বোঝার জন্য ডিগ্রিধারী গবেষক হবার প্রয়োজন নেই। একটু খেয়াল করলেই এই মৃত্যুর জন্য যে কারণগুলো পাওয়া যাবে সেগুলো হচ্ছে- নিরাপত্তাজনিত অবহেলা, অসচেতনতা এবং অনভিজ্ঞতা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়- যে 'মধ্যম আয়ের দেশ'টি নিজস্ব অর্থায়নে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু এবং সড়ক নির্মান করতে পারে তারা কেন সেইসব অবকাঠামো নির্মানের সময় নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারে না? তাহলে উত্তর হিসেবে অবধারিতভাবে যে কারণটি আসবে সেটি হচ্ছে- 'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ'।

বদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসের পর চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এই ঘটনায় হতাহতের জন্য প্রকাশ্য বক্তব্যে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কোষাধক্ষ‌্য এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামকে দায়ী করেছিলেন। অভিযোগ মতে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সালাম সাহেব নিজের পছন্দের লোকদের ঐ ফ্লাইওভার নির্মানের কাজ দিয়েছিলেন, যাদের গাফিলতি এবং অনভিজ্ঞতার কারণেই গার্ডার ধ্বসে ঐ হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। শেষ পর্যন্ত ঐ বিপর্যয়ের পর সেনাবাহিনীকে অসমাপ্ত ফ্লাইওভার নির্মানের কাজ শেষ করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে- মাত্র দুই বছরের মাথায় বদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পুলিশ আব্দুস সালামের নাম বাদ দিয়ে আদালতে চার্জসিট দাখিল করেছিল; শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে তার মেয়াদ আরো দুই বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বলা হয়ে থাকে-  নেতারা দৃষ্টান্তের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন; আদেশের মাধ্যমে নয়। বদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে হতাহতের জন্য দায়ী ব্যক্তিকে মামলা হতে অব্যাহতি এবং তার দায়িত্বে বহাল রেখে যে দৃষ্টান্ত তৈরি করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে: 'তুমি যদি আমাদের সাথে থাক, তাহলে কোন ভয় নেই, তোমার গাফিলতির কারণে কত মানুষের জীবনহানী ঘটলো সেটা কোন ব্যাপার না।'

ফলাফলও হাতেনাতেই পাওয়া গেছে। গত বছর জুন মাসে পিরোজপুরে একটি সেতু নির্মানের মাত্র একমাস পরই ধ্বসে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আর এখন একইভাবে খোদ রাজধানীতে নির্মানাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে এক দূস্থ কাঠমিস্ত্রীর প্রাণহানী ঘটেছে।

বিগত কয়েক বছরে সরকারী অবকাঠামো নির্মানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যাপক অবহেলা, পর্যবেক্ষনে অনীহা, অস্বাভাবিক ব্যয় এবং নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অনেক প্রমান দেখা গেছে। সরকারী অবকাঠামো নির্মানের টেন্ডারবাজী নিয়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে অভ্যন্তরীন মারামারি, রডের বদলে বাঁশের ব্যবহার এবং যোগ্যতা বিচার না করে আওয়ামী লীগ দলীয় লোকদের অবকাঠামো নির্মানের দায়িত্ব দেয়ার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিক-পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী মালিবাগে ধ্বসেপরা ফ্লাইওভারের নির্মানকাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানটির মালিকও আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রী।

এটা এখন একটা ওপেন সিক্রেট যে, দলীয় বিবেচনায় সরকারী অবকাঠামো নির্মানের দায়িত্ব দিলে মোটা দাগে তিনটি সমস্যা হয়:
প্রথমতঃ এত বড় মাপের অবকাঠামো তৈরীর কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা এদের থাকে না এবং জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিকে এরা মোটেই পাত্তা দেয় না।

দ্বিতীয়তঃ কার্যাদেশ পাবার পর এরা মোটা অংকের কমিশনের বিনিময়ে গোপনে কাজটি অন্য কোন নির্মান প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি তাদের দেয়া কমিশনের ক্ষতি পোষানোর জন্য নির্মানকাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে।

তৃতীয়তঃ এই নির্মাতারা অধিক মুনাফার জন্য জেনে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে নির্মানকাজে অপর্যাপ্ত ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে এবং অবকাঠামোগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রেখে বিল তুলে নিয়ে যায়।

অন্যদিকে সরকারী অবকাঠামো নির্মানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের এমন 'দুর্নীতি' এবং 'অবহেলা'র সমালোচনাকারীদেরকে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা 'উন্নয়ন বিরোধী' এবং 'উন্নয়নের শত্রু', হিসেবে চিহ্নিত করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন।

অনেকই হয়তো এই মৃত্যুগুলোকে 'দুর্ঘটনা', 'ভুল' কিংবা অন্যকিছু বলবেন। কিন্তু একবার কী নিজের বিবেককে প্রশ্ন করবেন- এই সবগুলো মৃত‌্যুকে কী কেবলমাত্র 'দুর্ঘটনা' বলা যায়?